Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

বিভাগের ঐতিহ্য

হযরত পীর খাজা খানজাহান আলী (র.) স্মৃতি বিজড়িত ও ভৈরব-রূপসা বিধৌত খুলনার ইতিহাস-ঐতিহ্য গৌরব মন্ডিত। খুলনা নামকরণের উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত মতগুলো হচ্ছে- ধনপতি সওদাগরের দ্বিতীয় স্ত্রী খুলনার নামে নির্মিত ‘খুলনেশ্বরী মন্দির' থেকে খুলনা নামের উৎপত্তি। ১৭৬৬ সালে ‘ফলমাউথ' জাহাজের নাবিকদের উদ্ধারকৃত রেকর্ডে লিখিত Culnea শব্দ থেকে খুলনা। অনেক বিজ্ঞজনের মতে ‘কিসমত খুলনা' মৌজা থেকে খুলনা নামের উৎপত্তি হয়েছে।  বৃটিশ আমলের মানচিত্রে লিখিত Jessore-Culna শব্দ থেকে খুলনা এসেছে বলেও অনেকের ধারণা। তবে কোনটি সত্য তা এখনও গবেষণার বিষয়।

খুলনা পৌরসভার জন্ম বৃত্তান্তে আসতে গেলে দেখা যায় যে, খুলনা পৌর এলাকা অতীতে জসর (যশোর) জেলার মুরলী থানার অন্তর্গত ছিল। পরে রূপসা নদীর পূর্ব পাড়ে তালিমপুর, শ্রীরামপুর (রহিমনগর) এর কাছে সুন্দরবনের জঙ্গল কেটে নতুন থানা স্থাপন করা হয় এবং এর নাম দেয়া হয় নওবাদ (নয়াবাদ)। কারো মতে এ নতুন থানা ১৭৮১ খ্রিঃ আবার কারো মতে ১৮৩৬ খ্রিঃ সৃষ্টি হয়। ১৮৪২ সালে খুলনা মহকুমার জন্ম হয়। অবিভক্ত বাংলার প্রথম মহকুমা খুলনা। পরে তার পরিধি সম্প্রসারিত হয়ে বর্তমানের খুলনা ও বাগেরহাট জেলা দু'টি নিয়ে ছিল খুলনা মহকুমা। ১৮৬৩ সালে বাগেরহাটে স্বতন্ত্র মহকুমার কার্যালয় স্থানান্তরিত হয়। এরপর ১৮৪৫ সালে সেখানে প্রথম দালান কোঠা ওঠে যা আজকে জেলা প্রশাসকের বাসভবন। খুলনার প্রথম প্রশাসক ছিলেন ডেপুটি মিঃ শোর এবং দ্বিতীয় মহকুমা হাকিম ছিলেন সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি এই বাসভবনে বসে তার উপন্যাস ‘দুর্গেশ নন্দিনী' রচনা করেছিলেন। পরে ১৮৮২ সালের ২৫ এপ্রিলের সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী খুলনা জেলার জন্ম হয় এবং তৎকালীন যশোর জেলার খুলনা ও বাগেরহাট মহকুমা দুটি এবং ২৪ পরগনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমা নিয়ে ঐ সালের ১ জুন থেকে এ নতুন জেলার কাজ শুরু হয়। প্রথম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন মিঃ ডব্লুউ এন ক্লে তার নামানুসারে শহরের ক্লে রোড হয়েছে।

খুলনা জেলা শহর হলেও এখানে বেশীদিন আগে জনবসতি গড়ে ওঠেনি। মুলতঃ সুন্দরবনের জঙ্গল কেটে রূপসা ও ভৈরব নদীর পাড়ে জনবসতি গড়ে ওঠে। মূল শহর থেকে কিছুটা দূরে ভৈরব নদীর অপর পাড়ে সেনহাটিতে খুলনার প্রথম জনবসতি গড়ে ওঠে বলে ইতিহাস সূত্রে জানা যায়। ১৮৬৯ সালের ১ এপ্রিল খুলনার প্রথম মিউনিসিপ্যালিটি স্থাপন করা হয় সাতক্ষীরাতে। দ্বিতীয় মিউনিসিপ্যালিটি গঠিত হয় ১৮৭৬ সালে বর্তমান সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটায়। তবে ১৯৫৫ সালে সেটি বাতিল হয়ে ইউনিয়ন বোর্ডে পরিণত হয়। জেলার তৃতীয় মিউনিসিপ্যালিটি গঠিত হয় ১৮৮৪ সালে খুলনা শহরে। এর দুই বছর পর ১৮৮৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর মিউনিসিপ্যালিটির দ্বিতীয় সভায় ভাইস চেয়ারম্যান বাবু কৈলাশচন্দ্র কাঞ্জিলালের বাড়ি সত্যচরণ হাউসে সাময়িক ব্যবস্থা হিসাবে মিউনিসিপ্যালিটির অফিস স্থাপন করা হয়। এখান থেকেই মূলত পরিচালিত হতো শহরের প্রশাসনিক কর্মকান্ড। আজ আর সে ভবনের অস্তিত্ব না থাকলেও অনেকের মতে ভবনটি বর্তমান পৌর ভবনের সন্নিকটে  ছিল।
খুলনা মিউনিসিপ্যালিটির জন্ম বৃত্তান্ত খুঁজতে গিয়ে একশ' বছর আগের একটি গেজেট থেকে জানা যায়, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে বাংলার লেফটেন্যান্ট-গবর্নর ১৮৭৬ সালের একযাক্ট, ৫(বিসি) এর ৮নং ধারা মতে ১৮৮৪ সালের ১ জুলাই থেকে কয়লাঘাট ও হিলাতলা (হেলাতলা)সহ খুলনা, বানিয়াখামার, টুটপাড়া, গোবরচাকাসহ শিখপাড়া (শেখপাড়া), নুরনাগুর (নুরনগর), চারাবাটিসহ শিববাটি, বারিয়াপাড়াসহ ছোট বয়রা গ্রামসমূহ নিয়ে খুলনাকে ২য় শ্রেণীর মিউনিসিপ্যালিটি করার জন্য ১৮৮৪ সালের ১৮ মে এক বিজ্ঞপ্তি জারী করেন। ঐ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের এক মাসের মধ্যে গ্রহণযোগ্য আপত্তি উত্থাপিত না হলে, প্রস্তাব কার্যকর করা হবে বলে জানানো হয়। ‘দি ক্যালকাটা গেজেটে' ১৮৮৪ সালের ২৮ মে সংখ্যার ৬৩৮ পাতার মুদ্রিত মিউনিসিপ্যালিটির প্রস্তাবিত চৌহদ্দী ছিল উত্তরে ভৈরন নদী, পূর্বে ভৈরব ও রূপসা নদীসমূহ, দক্ষিণে- মতিয়াখালী খাল এবং লবণচরা খাল এবং মইয়া নদীর উত্তরাংশ এবং পশ্চিমে- বড় বয়রার দক্ষিণ পূর্ব অংশ, গোয়ালপাড়া এবং মুফগুন্নি (মুজগুন্নি)।
পরবর্তীতে ১৮৮৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বরের বিজ্ঞপ্তি দ্বারা বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর খুলনাকে মিউনিসিপ্যালিটি ঘোষণা করেন। এ বিজ্ঞপ্তিটি দি ক্যালকাটা গেজেটে ১৮৮৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ৯৫৩ পাতায় মুদ্রিত হয়। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কারণসম্মত আপত্তি পড়ায় শেখপাড়াসহ গোবরচাকা এবং নুরনগর বাদ দিয়ে কয়লাঘাটাসহ খুলনা, হেলাতলা, বানিয়াখামার, টুটপাড়া, চারাবাচিসহ শিববাঠী এবং বারিয়াপাড়াসহ ছোট বয়রা নিয়ে মিউনিসিপ্যালিটি ১৮৮৪ সালের ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর করা হয়। এ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ১৮৮৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে খুলনা মিউনিসিপ্যালিটির প্রথম চেয়ারম্যান হিসাবে রেভারেন্ড গগণচন্দ্র দত্ত কার্যভার গ্রহণ করেন। একশ' ৫৬ বছর আগে ১৮৫৬ সালে কালেক্টর ভবনের পাশে  খুলনার প্রথম  মসজিদ স্থাপিত হয়। এই মসজিদটি নগরীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ঈদগাহ জামাত স্থল। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম স্থান খুলনা। নদী বন্দর, উন্নত সড়ক ও রেল যোগাযোগ এবং সমতল ভুমির কারণে এ শহরটি প্রসারিত হচ্ছে দ্রুতগতিতে। জনবসতি বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে খুলনার ভুমিকা অগ্রগামী।

খুলনা জেলা : খুলনা জেলার বর্তমান আয়তন ৪ হাজার ৩৯৪.৪৬ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের সর্বশেষ আদম শুমারী অনুযায়ী খুলনা মহানগরীসহ জেলার লোকসংখ্যা ২৩ লাখ ১৮ হাজার ৫২৭ জন। এরমধ্যে  খুলনা মহানগরীর লোকসংখ্যা ৭ লাখ ৯১ হাজার ২৯৭ জন। পুরুষ ১১ লাখ ৭৫ হাজার ৮৮৬ ও মহিলা ১১ লাখ ৪২ হাজার ৮৪১ জন। তবে সিটি কর্পোরেশনের হিসাবে খুলনা মহানগরীর লোকসংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। ১৮৩৬ সালে খুলনা যশোর জেলার একটি থানা ছিল। ওই সময় থানার নাম ছিল নয়াবাদ। ১৮৪২ সালে ভৈরব নদীর ওপার থেকে বর্তমান স্থানে মহকুমা স্থানান্তর করা হয়। ১৮৮২ সালে জেলা স্থাপিত হয়।
খুলনা জেলায় নয়টি উপজেলা ও ১৪টি থানা রয়েছে। জেলা সদরের সাথে থানাগুলোর যোগাযোগ এখন অনেকটাই সহজ। তবে সুন্দরবন সংলগ্ন দাকোপ ও কয়রা উপজেলা এখনো সড়ক যোগাযোগে অন্য উপজেলাগুলো থেকে এখনো পিছিয়ে আছে।
কয়রা উপজেলা : কয়রা উপজেলা খুলনা জেলার সর্বদক্ষিণে অবস্থিত, এই উপজেলার দক্ষিণে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর উত্তরে পাইকগাছা উপজেলা, পূর্বদিকে শিবসা নদী ও দাকোপ উপজেলা এবং পশ্চিমে কপোতাক্ষ নদ ও সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলা। এই উপজেলার আয়তন ২ হাজার ৭৫ দশমিক ৯২ বর্গ কিলোমিটার। তন্মধ্যে সুন্দরবন এলাকা ১ হাজার ৮১২ দশমিক ৬৬ বর্গ কিলোমিটার এবং লোকালয় ২৬৩.২৬ বর্গ কিলোমিটার।

কয়রা উপজেলার অন্যতম খরস্রোতা নদী-কয়রা। সম্ভবতঃ কয়রা নদীর নামানুসারেই এই উপজেলার নাম হয়েছে কয়রা। এই উপজেলার সদর ইউনিয়নের নামও কয়রা। সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা উপজেলায় ৭টি ইউনিয়ন, ১৩০টি গ্রাম ও ৭২টি মৌজা রয়েছে। এ উপজেলার ইউনিয়ন ৭টি হলো, আমাদী, বাগালী, মহেশ্বরীপুর, মহারাজপুর, কয়রা, উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশী। কয়রা উপজেলা এক সময় পাইকগাছা থানার অংশ ছিল। ১৯৭৪ সালে পাইকগাছা থানাকে বিভক্ত করে আলাদাভাবে কয়রা থানা করা হয়। ১৯৮০ সালে কয়রা থানা পূর্ণাঙ্গ রূপলাভ করে।  এ উপজেলার বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৯২ হাজার ৫২০ জন। পুরুষ ৯৫ হাজার ৯৮০ জন এবং মহিলা ৯৬ হাজার ৫৪০ জন। এ উপজেলায় কলেজের সংখ্যা ৩টি। এরমধ্যে ১টি মহিলা কলেজ।  হাইস্কুল ৩৬টি। তন্মধ্যে ৪টি বালিকা বিদ্যালয়। এছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৫৪টি, রেজিস্ট্রী প্রাথমিক বিদ্যালয় ৫৭টি, মাদরাসা ২৫টি এবং মহিলা মাদরাসা ৪টি, এবতেদায়ী মাদরাসা ১৮টি। উপজেলার শিক্ষার হার ৩৮.১০ ভাগ।
কয়রা উপজেলার সাথে জেলা সদরের পাকা সড়ক যোগাযোগ আছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ভাল না থাকায় বর্ষাকালে অবস্থা সবচেয়ে খারাপ হয়। কয়রা উপজেলার মোট রাস্তা ২৪৩ কিলোমিটার, তন্মধ্যে পাকা সড়ক মাত্র ২১ কিলোমিটার, আধা পাকা ৮০ কিলোমিটার এবং কাঁচা রাস্তা ১৪২ কিলোমিটার। পাইকগাছা হয়ে খুলনা সদরের সাথে যোগাযোগের জন্য শিবসা নদীতে ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছে। কয়রার সাথে খুলনা জেলা সদরে লঞ্চ যোগাযোগ বিদ্যমান। স্বাস্থ্য সেবার অবস্থা বেশ খারাপ। উপজেলার জায়গীরমহল গ্রামে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অবস্থিত। এই উপজেলায় ১৫৭টি মসজিদ, ১৭১টি মন্দির আছে। হিন্দু, মুসলিম ও অল্প কিছু সংখ্যক উপজাতি এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সাথে বসবাস করেন। কয়রা উপজেলায় ৪টি ব্যাংকের শাখা আছে।  ৪টি বীমা কোম্পানির শাখা, ৩৩টি হাট-বাজার, ৪৫টি ক্লাব আছে।

কয়রা উপজেলার অধিকাংশ লোকজন কৃষিজীবী, সুন্দরবনে কাঠ ও গোলপাতা কেটে, মধু, মাছ, জোংড়া ইত্যাদি সংগ্রহ করে জীবিকা অর্জন করে। এখানে নদীর লোনা পানি তুলে চিংড়ি চাষ হয়। কয়রা উপজেলায় ২ হাজার ৯৪৬টি চিংড়ি ঘের আছে।
কয়রা উপজেলা জেলার সর্বদক্ষিণে অবস্থিত হওয়ায় এখানে নানাবিধ সমস্যা বিদ্যমান, বিদ্যুতের সমস্যা, বেকারত্ব চরম, আইন-শৃক্মখলা পরিস্থিতির অবনতি এখানে লেগেই থাকে। সুন্দরবন রক্ষা করা, সুন্দরবনের পশু পাখী গাছ রক্ষা করা আবশ্যক, নদীর মাছ রক্ষা দরকার, হাটবাজারের সংস্কার আশু প্রয়োজন। পানীয় জলের সমস্যা অত্যন্ত প্রকট। বিশেষ করে চৈত্র-বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে খাবার পানির অভাবে মানুষের ভোগান্তির সীমা থাকে না।

প্রাচীন মসজিদের ইতিহাস : বৃহত্তর খুলনা জেলায় অনেক প্রাচীন মসজিদ আছে। ইতিহাসের আলোকে বিচার করলে দেখা যায়, সামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ (১৩১০-১৩২৫) প্রথম খুলনা আগমন করেন। সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের সময়ে (১৩৪২-১৩৫৮) খুলনা অঞ্চলে মুসলমানদের আগমন ঘটে। তারপর হযরত খান জাহান আলী (রা.) (--------১৪৫৯) এ অঞ্চলে মুসলিম শাসন চালু করেন। সুলতান শাহ সুজার আমলে এ অঞ্চলের বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছিল জিয়াদখানা নামে। তার নাম ছিল সুন্দরবন। বৃহত্তর খুলনা জেলায় শ' শ' বছর আগে ইসলাম প্রচারক ও মুসলিম শাসক কর্তাদের আগমনের সাথে সাথে তাঁরা অনেক মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এ মসজিদগুলোর নির্মাণ কৌশল চমৎকার তাছাড়া স্থাপনা শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। এগুলোকে প্রাচীন মসজিদ বলা হয়। বৃহত্তর খুলনা জেলায় এ ধরণের কতটি মসজিদ ছিল তার সঠিক হিসেব পাওয়া যায় না। বেশ কিছু সংখ্যক প্রাচীন মসজিদ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিলীন হয়ে গেছে। কালের সাথে যুদ্ধ করে যে সব প্রাচীন মসজিদ টিকে আছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ বর্তমান খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলাভিত্তিক তুলে ধরা হলো। বর্তমানে খুলনা জেলায় মোট মসজিদের সংখ্যা ১ হাজার ৩শত ৭৪টি। তার মধ্যে প্রাচীন মসজিদের সংখ্যা ৮টি। মসজিদকুড় মসজিদ : খুলনা মহানগরী থেকে ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে কয়রা উপজেলায় আমাদী গ্রামে মসজিদকুড় মসজিদ অবস্থিত। এটি নির্মাণ করেছিলেন হযরত খানজাহান আলীর (র.) একান্ত সহচর হযরত বুড়ো খাঁ (র.)। তিনি ধর্ম প্রচারের সাথে রাজ্য শাসন ও জমি পত্তন করতেন। মসজিদটি সুন্দরবনের অবিস্মরণীয় কীর্তি। এটি বর্গাকার। এর প্রত্যেক বাহুর দিকে ৫৪ ফুট ও ভিতরের দিকে ৪০ ফুট লম্বা। মসজিদের তিনটি প্রবেশপথ আছে। মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে আছে তিনটি মেহরাব। আছে চারটি মিনার। মসজিদটির বাইরের দেয়ালে দক্ষিণ পূর্ব ও উত্তর দিকে পোড়া মাটির চিত্র ফলকের দ্বারা অংকিত ছিল। মসজিদের মধ্যে ৪টি প্রস্তর স্তম্ভ আছে। আরো আছে ৯টি গম্বুজ। গম্বুজের নির্মাণ কৌশল খুবই চমৎকার।

আরশ নগরের মসজিদ : খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার আরশনগর গ্রামে একটি মসজিদ আছে। মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল ইংরেজি ১৫০০ সালে। যতদূর জানা যায়, এ মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন পিরে কামেল শেখ শাহ আফজাল (র.) তিনি হযরত খানজাহান আলীর (র.) সাথে ইসলাম প্রচারে এসেছিলেন। এক পর্যায়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মসজিদটি ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়। ১৯৮৩ সালে ধ্বংস স্তুপ থেকে মসজিদটি উদ্ধার করে সংস্কার করা হয়। মসজিদের ভিতর থেকে একটি শিলা লিপি উদ্ধার করা হয়। তাতে একটি হাদিস লেখা আছে। বর্তমানে শিলা লিপিখানি রাজশাহী বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত আছে।
বেতকাশী মসজিদ : কয়রা উপজেলায় বেতকাশি গ্রামে একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল হযরত খানজাহান আলীর (র.) সময়ে। এটি নির্মাণ করেছিলেন তার একান্ত সহচর হযরত খালেক খাঁ (র.) মসজিদটি কারুকার্য খচিত করে নির্মাণ করা হয়েছিল।
সোলায়মান পুরের মসজিদ : পাইকগাছা উপজেলায় সোলায়মানপুর গ্রামে একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল হযরত খানজাহান আলীর (র.) আমলে। এটি নির্মাণ করেছিলেন তার সাথে আসা এক শিষ্য হযরত বোরহান উদ্দিন খান (র.)। মসজিদটি খুবই সুন্দর ছিল।

আলাইপুরের মসজিদ : রূপসা উপজেলার আলাইপুরে একটি প্রাচীন মসজিদ আছে। মসজিদটি দেখতে খুবই চমৎকার। তবে মসজিদটি কে নির্মাণ করেছিলেন তার সঠিক ইতিহাস এখনো অনুদঘাটিত। তবে এটি খানজাহান আলীর (র.) সময় নির্মিত হয়েছে বলে বিজ্ঞজনেরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

চিংড়া মসজিদ : ডুমুরিয়া উপজেলার চিংড়া গ্রামে একটি প্রাচীন মসজিদ আছে। মসজিদটি কে নির্মাণ করেছেন তার সঠিক তথ্য জানা যায় না। অনেকের ধারণা এ মসজিদটিও খানজাহান আলীর (র.) সময়ে নির্মিত হয়েছিল। এ মসজিদ নিয়ে অনেক অলৌকিক কথা শোনা যায়।
টাউন জামে মসজিদ : খুলনা মহানগরীর সবচেয়ে পুরানো মসজিদ টাউন জামে মসজিদ। এ মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল ১৮৫৪ সালে। এটি ভৈরব নদের পাড়ে কেডি ঘোষ রোডের পূর্ব দিকে অবস্থিত। মসজিদটি দেখতে খুবই সুন্দর।
টুটপাড়া জামে মসজিদ : নগরীর টুটপাড়া বড় পুরানো জামে মসজিদটি ১৮৮০ সালে নির্মিত হয়। এ মসজিদটি দেখতে খুব সুন্দর।

বায়তুন নূর মসজিদ : নগরীর সবচেয়ে আধুনিক মসজিদ হচ্ছে বায়তুন নূর মসজিদ কমপ্লেক্স। মসজিদটি ১৯৮০ সালের ২২ নবেম্বর তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. নূরুল ইসলামকে   সভাপতি করে এই মসজিদ নির্মাণের প্রথম কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৯২ সালের ১৮ ডিসেম্বর তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ.এস. এম মোস্তাফিজুর রহমান মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ মসজিদে এক সাথে ৬ হাজার মুসল্লি নামায আদায় করতে পারেন। মহিলাদের জন্যও মসজিদটিতে আছে আলাদা নামাযের স্থান। এছাড়া মসজিদটির তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় আছে মাদরাসা ও ইসলামী পাঠাগার। মসজিদটির মিনার ১৩৮ফুট উচ্চতা।
ঈদ জামাতের ইতিহাস : রোজার ঈদ মুসলিম জাহানের একটি উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় উৎসব। পবিত্র রমজান মাসের ও সংযম সাধনের পর আরবি শাওয়াল মাসের ১ তারিখে ঈদুল ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর মদিনায় হিযরতের পর থেকে ঈদ উৎসব পালিত শুরু হয়। আর আজকের বাংলাদেশের প্রথম কোথায় ঈদুল ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছিল তার সঠিক কোন ইতিহাস পাওয়া যায় না। ইদ্রিসুর রহমান ‘ঈদুল ফিতর' বাংলার প্রাচীন উৎসবগুলোর অন্যতম। কিন্তু প্রাচীনকালে ঈদের দিনটি কিভাবে পালন করতো সে সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। ১৭শ' শতকের দিকে বাংলার নবাবরা এবং বিত্তবানরা ঈদ উৎসব জাঁকজমকভাবে পালন করতেন। মোগল আমলে মোগলরা ঈদ উৎসব পালন করতেন। এসময় গ্রামের মুসলমানরা ছিলো দরিদ্র। ইসলাম সম্পর্কে তাদের বিশুদ্ধ জ্ঞানও ছিলো না। ফরায়জী আন্দোলনের পর থেকে ইসলাম সম্পর্কে সাধারণ মুসলমানরা জানতে শেখে। ইংরেজ আমলের প্রধান উৎসব ছিলো ক্রিসমাস। তখন মুসলমানরা ঈদের অতিরিক্ত ছুটির জন্য আবেদন করলেও ইংরেজরা তাতে কর্ণপাত করেনি। ওই সময় বিত্ত-বিদ্যার দিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা হিসেবে অনেক এগিয়ে ছিলো। ফলে দুর্গাপূজাও সম্প্রদায়গত আধিপত্য এবং ঐতিহ্যের কারণে হয়ে উঠলো সবচেয়ে জাঁকালো এবং গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। এরপর মুসলমান সম্প্রদায় রাজনীতিতে এলে ঈদ উৎসব নতুন মর্যাদা পায়। আজ আমরা যে ঈদের জন্যে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করি, প্রধান ধর্মীয় উৎসব বলে জানি এবং বড় উৎসবের ইতিহাস মাত্র ৮০ থেকে ১০০ বছরের পুরানো। বিশ শতকের স্বাতস্ত্র্য আন্দোলন শুরু হলে ঈদ উৎসব নতুনভাবে গুরুত্ব লাভ করে। ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশে দু'টি ঈদই জাতীয় ধর্মোৎসব রূপান্তরিত হয় এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। আর খুলনা মহানগরীর এলাকার মধ্যে প্রথম কোথায় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় তার কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে বৃটিশ আমলের আগে থেকে খোলা জায়গায় ঈদের জামাত হতো বলে জানা যায়। হযরত খানজাহান আলী (র.) খুলনা অঞ্চলের ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তখন থেকেই খুলনা মহানগরী এলাকার মধ্যে মুসলমানদের বসবাস শুরু হয়েছিলো। মহানগরীর দৌলতপুর ও খালিশপুর একটি প্রাচীন স্থান। এ দু'টি নামের সাথে দু'জন মুসলিমের নাম জড়িত। দৌলত খাঁ থেকে নাকি দৌলতপুর নাম হয়েছিলো। আর হযরত উলুগ খান-ই-জাহানের একজন বিশেষ সহচর ছিলেন খালাশ খান। তিনি নাকি আজকের খালিশপুর এলাকায় বসতি স্থাপন করে অনেক লোককে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার নামানুসারে নাকি খালাশ খান থেকে খালিশপুর নাম হয়েছে। তবে সে সময়ে মুসলমানরা এখানে কিভাবে ঈদ উৎসব পালন করতেন তার কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। অপরদিকে মহানগরী এলাকার মধ্যে কখন প্রথম মুসলমানদের বসবাস শুরু হয় তার ইতিহাসও ধূসর। খুলনা মহানগরীর প্রধান ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দানে। এটি মহানগরীর সবচেয়ে বড় জামাত। লক্ষাধিক মুসল্লি এ জামাতে ঈদের নামায আদায় করেন। খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানের ঈদের জামাতে মন্ত্রী, মেয়র, এমপি, খুলনা মহানগরীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ সর্বস্তরের মুসলমান শরীক হন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনা মহানগরী এলাকায় বৃটিশ আমলে যেখানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হতো তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : খুলনা টাউন জামে মসজিদ (১৮৫৪)। ১৮৬৫ সাথে টাউন জামে মসজিদে খুলনায় প্রথম ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া টুটপাড়া বড় পুরানো জামে মসজিদে(১৮৮০), শেখপাড়া আস্তানা মসজিদ, হাজি বাড়ি মসজিদে, বানিয়া খামার পশ্চিম পাড়া মসজিদে ও দৌলতপুরের সাহিত্যিক ডা. আব্দুল কাসেমের বাড়ির কাছের ঈদগাহসহ আরো কয়েকটি স্থানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হতো।
শিক্ষা : শিক্ষার প্রসারেও খুলনা জেলার গুরুত্ব অপরিসীম। এ জেলায় ৬২৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪৬১টি রেজিস্ট্রার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩৪টি কমিউনিটি বিদ্যালয়, ৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২০টি বেসরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৬৪টি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৬টি সরকারি কলেজ, ১০৪টি দাখিল মাদরাসা, ১৬টি আলিম মাদরাসা, ১২টি ফাজিল মাদরাসা, ৩টি কামিল মাদরাসা, একটি পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, একটি সরকারি কৃষি কলেজ, একটি মেডিকেল কলেজ ও ২টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এছাড়া বেসরকারি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউট রয়েছে। খুলনা শহরে প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৮৮০ সালে ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় ‘খুলনা জিলা স্কুল' ১৮৮৫ সালে স্থাপিত হয়। শুরুতে প্রাথমিক বিদ্যালয়টির নাম ছিল কালাচাঁদের পাঠশালা (টুটপাড়া)। এ শহরে ১৯০২ সালে প্রথম কলেজ স্থাপিত হয়। আজকের সরকারি বিএল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজটির নাম ছিল ‘হিন্দু একাডেমী'। নগরীর অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আযমখান সরকারি কমার্স কলেজ। ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেঃ জেনারেল আযম খানের নামে কলেজটি স্থাপিত হয়। দেশের বাণিজ্য শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখে চলেছে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি।

অফিস-আদালত : দেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর খুলনা বিভাগীয় সদর। এ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দশটি জেলা। এখানে বিভাগীয় কমিশনারের সচিবালয়, উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক ও মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়, কালেক্টরেট ভবন, জজকোর্ট, খুলনা জেলা পরিষদ ভবন, পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জন, আনসার ও ভিডিপি কার্যালয়, মুখ্য মহানগর হাকিমের কার্যালয়, সিভিল ডিফেন্স ও ফায়ার সার্ভিস, টেলিযোগাযোগ অফিসসমূহ, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ভবন, বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালত, বন ভবন, সুন্দরবন বিভাগের কার্যালয়, বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন অফিস, পোস্ট মাস্টার জেনারেল দক্ষিণাঞ্চলের কার্যালয়, কর বিভাগের অফিস, কাষ্টমস হাউস, রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো অফিস, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা উপ পরিচালকের অফিসসহ বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অফিস, জেলা ও থানা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস ও জেলা শিক্ষা অফিস, পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের বিভিন্ন অফিস, ওষুধ প্রশাসনের অফিস, মৎস্য পশু খাদ্য, বিদ্যুৎ, পানি, দুর্নীতি দমন, মাদক নিয়ন্ত্রণ, কৃষি, শিপিং, তথ্য বিভাগ, যুব উন্নয়ন অধিদফতর, পাসপোর্ট অফিস, গণপূর্ত বিভাগ, ফ্যাসিলিটিজ বিভাগ, জনস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিভাগের অফিস রয়েছে।

আরো আছে বিভিন্ন বীমা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, রেডিও স্টেশন, টেলিভিশন স্টেশন, স্টেডিয়াম, পোস্ট অফিস, বিভিন্ন শ্রেণীর হোটেল, ক্লিনিক, ক্লাব, কারাগার, সার্কিট হাউস, ডাক বাংলো, প্রেসক্লাব, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমী, শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়, চেম্বার অব কমার্স, ষ্টীমার ঘাট, খেয়াঘাট, বিমান অফিস, নিউ মার্কেট, পার্ক, পাবলিক হল, বাস টার্মিনাল, রেল ষ্টেশন, শিশু একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, সেনানিবাস, চিড়িয়াখানা, প্রেম কানন, পিকচার প্যালেস, শংখ, স্টার, উল্লাসিনী, সঙ্গীতা, সোসাইটি, ঝিনুক, বৈকালী, জনতা, মিনাক্ষী, চিত্রালী, লির্বাটি, সাগরিকা সিনেমা হলসহ বহু দর্শনীয় স্থান।

শিল্পকলকারখানা : উন্নত সড়ক, নৌ ও রেল যোগাযোগের কারণে গত শতাব্দীর ৫০'এর দশকে খুলনায় একের পর এক শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠতে থাকে। ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে মাত্র ১৭ বছরে দৌলতপুর জুট মিল্স লিঃ, প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিল্স লিঃ, ষ্টার জুট মিল্স লিঃ, ক্রিসেন্ট জুট মিল্স লিঃ, পিপলস জুট মিল্স লিঃ, এ্যাজাক্স জুট মিল্স লিঃ, সোনালী জুট মিল্স লিঃ, মহসিন জুট মিল্স লিঃ, আলীম জুট মিল্স লিঃ, ইষ্টার্ণ জুট মিল্স লিঃ ও আফিল জুট মিল্স লিঃ, নিউজপ্রিন্ট মিল্স, হার্ডবোর্ড মিল্স, কেবল ফাক্টরি, টেক্সটাইল মিল্স, দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি, শিপইয়ার্ড, ডকইয়ার্ড, জুট বেলিং প্রেসসহ সরকারি বেসরকারি বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এছাড়া স্বাধীনতার পর সাদা সোনা চিংড়ি ও সাধা মাছ চাষের ফলে খুলনাতে গড়ে উঠেছে অর্ধ শতাধিক মাছ কোম্পানি। এসব শিল্প কলকারখানায় হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। তবে গত শতকের ৮০'র দশকে সরকারের ভ্রান্তনীতির কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানের কবলে পড়তে থাকে। এক পর্যায়ে নিউজপ্রিন্ট মিল্স, দৌলতপুর জুটমিলসহ বেশ কয়েকটি ভারী শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এতে খুলনার ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আসে। তবে শিল্প নগরী খুলনা আবারো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি জুটমিলসহ শিল্প প্রতিষ্ঠান। খুলনা শিপইয়ার্ড লোকসান কাটিয়ে উঠে এখন লাভ করছে। ইতিমধ্যে এখানকার তৈরি যুদ্ধ জাহাজ বাংলাদেশ নৌ বাহিনী ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া জাহাজ রফতানির জন্য বিদেশের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে খুলনা শিপইয়ার্ড। এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটি এখন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।
সিনেমা হল : আকাশ সংস্কৃতির অবাধ প্রবেশ, নিমোনের চলচ্চিত্র নির্মাণ ও দর্শক হারানোর কারণে খুলনার ২০টি সিনেমা হলের মধ্যে ১১টিই বন্ধ হয়ে গেছে। আর যেসব হল চালু রয়েছে সেগুলো চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সেই সঙ্গে বন্ধের তালিকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি হল। বর্তমানে যেসব সিনেমা হল চালু রয়েছে সেগুলো হলো-শক্মখ, সংগীতা, সোসাইটি, পিকসার প্যালেস, ঝিঁনুক, চিত্রালী, লিবার্টী, গ্যারিসন এবং রূপসাগর।

সুন্দরবন : সুন্দরবন সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি হিসেবে অখন্ড বন যা বিশ্বে সর্ববৃহৎ। অববাহিকার সমুদ্রমুখী সীমানা এই বনভূমি গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মোহনায় অবস্থিত এবং বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিস্তৃত। ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে। সুন্দরবন ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর ‘বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী' স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

সুন্দরবনের পুরোটাই যেন অজানা রূপ-রহস্য আর রোমাঞ্চে ভরা। বিশ্বের বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ বনের বাসিন্দা ভয়ঙ্কর সুন্দর বেঙ্গল টাইগার কিংবা বিষধর সাপ শক্মখচূড়া। আরও আছে জলের বাসিন্দা কুমির, ডলফিন, হাঙ্গর, বিরল প্রজাতির কচ্ছপ ও পাখ-পাখালির দল। সুন্দরবনের শক্মখচূড়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিষধর সাপ। এ সাপ ভারতের কেরালা থেকে শুরু করে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া হয়ে ফিলিপাইন পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের ঘন জঙ্গলে দেখতে পাওয়া যায়। ওজনে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম পাইথন সুন্দরবনে পাওয়া যায়। তবে সংখ্যায় অত্যন্ত কম।কুমিরের ৩৬ প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বড় ইন্দোপ্যাসিফিক খাঁড়ির কুমির। এ কুমিরের কিছু সুন্দরবনে এখনো বেঁচে আছে। এদের দু-একটি শিকারিদের এড়িয়ে এখনোটিকে আছে যেগুলোর আকার দুঃস্বপ্নে দেখা অতিকায় ডাইনোসরের মতো। সুন্দরবনের গাছের মধ্যে আছে সুন্দরী, গরান, ধুন্ধল, কেওড়া প্রভৃতি।
পুরাকীর্তি : খুলনা জেলায় হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম আমলের অনেক পুরাকীর্তি ছিল। কালের বিবর্তনে অনেক কীর্তি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হিন্দু কীর্তির মধ্যে রয়েছে- নগরীর মহেশ্বরপাশার জোড়া মন্দির, যাতার দোল, পাইকগাছা উপজেলার কপিলেশ্বরী মন্দির, রূপসা উপজেলার পিঠাভোগ গ্রামে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র পুরুষের বাড়ি ও ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণ ডিহি গ্রামে বিশ্বকবির শ্বশুর বাড়ি প্রভৃতি। কপিলমুনিতে এক সময় অনেক বৌদ্ধ আশ্রম ছিল। এখন তা আর নেই। মুসলিম পুরাকীর্তির মধ্যে আছে- কয়রা উপজেলার মসজিদ কুঁড়ের মসজিদ, বুড়ো খাঁ, ফতে খাঁর মাজার, মদীনাবাদের প্রাচীন কবর। ডুমুরিয়া উপজেলার আরস নগরের মসজিদ, মাগুরা ঘোনার ছালামত খাঁ মাজার, চিংড়ার মসজিদ। ফুলতলা উপজেলার মিছরী দেওয়ান শাহের মাজার, মুক্তেশ্বরী গ্রামের দীঘি, পাইকগাছা উপজেলার সরল খাঁর দীঘি। তাছাড়া খুলনা মহানগরীর পাশে রয়েছে বুড়ো মৌলভীর দর্গা। আরো আছে সুফি খাঁর গড়, খাজা ডাঙ্গার প্রাচীন কবর, মহারাজপুরের কীর্তি, শাকবাড়ের লবণের কারখানা, আলাইপুরের মসজিদ, গোরা ডাকাতের বাড়ি প্রভৃতি।

কিংবদন্তী : খুলনা জেলার বিভিন্ন এলাকায় মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে অনেক কিংবদন্তী। সংগৃহিত কিছুসংখ্যক কিংবদন্তির হচ্ছে- বনবিবি, ভূতের বাড়ি, গোরা ডাকাতের বাড়ি, নদীর নাম রূপসা, মিছরী দেওয়ান শাহ, চাঁদবিবি, সোনার কুমড়ো, গাজীর ঘুটো, দুধ পুকুর, কুদির বটতলা, শ্বেত পাথর, পীর ধরম চাঁদ, আলম শাহ ফকির, মহেশ্বরপাশার জোড় মন্দির, ল্যাটা ফকির প্রভৃতি।

পেশাভিত্তিক লোকজ সংস্কৃতি : কোন জাতির প্রাণ স্পন্দনকে ধারণ করে লোকজ সংস্কৃতি। আমাদের জাতীয় সত্তাকে ধারণ করেই লোকজ সংস্কৃতি বেড়ে ওঠেছে। প্রখ্যাত লোক বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড.ওয়াকিল আহমেদ বলেছেন, ‘দেশাচার, লোক প্রথা প্রচলিত বিধি ব্যবস্থা যা তা পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে দেখে-শুনে লাভ করে, তাই লোক সংস্কৃতির সম্পদ। অর্থাৎ লোক সংস্কৃতি প্রধানতঃ ঐতিহাসিক। পৈতৃক সম্পতির মতো এগুলো বিনা দ্বিধায়, বিনা বিচারে গ্রহণ করেও পালন করে। গভীর অনুধ্যান ও অনুশীলন নেই বলে লোক ভাবনার দ্বারা নতুন উদ্ভাবন সম্ভব হয় না। লোক সংস্কৃতি স্থুলতা ও অশালীনতার কারণে এর নন্দনতত্তের আবেদন তেমন হৃদয়গ্রাহী হয় না। ব্যবহারিক প্রয়োজন, নিরপেক্ষ অভ্যাস ও আচারণ লোক সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্য দেখা যায় না। লোক সংস্কৃতি মননশীল নয়। এতে স্বভাব ও প্রবৃত্তির ছাপ বেশী পড়ে। এজন্য লোকসংস্কৃতি অকৃত্রিম সরলতা ও স্বাভাবিকতা লোক সংস্কৃতির ভূষণ। জনসাধারণের অক্ষর জ্ঞান নেই বলে তারা কোন কিছু গ্রন্থবদ্ধ করে রাখে না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই লোক জ্ঞানের প্রধান উৎস। লোকমুখে তা প্রচালিত হয়, লোক শ্রুতিতে গৃহীত ও লোকস্মৃতিতে রক্ষিত হয়। এরূপ ক্ষেত্রে নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, তথা জাতিতত্ত্বের প্রকৃত উপাদান লোক সংস্কৃতিতে প্রবাহমান থাকে। সুতারাং একটি দেশের একটি জাতির মৌলিকতা ও স্বকীয়তার পরিচয় তার লোক সংস্কৃতির দ্বারাই সম্ভব'।
লোকজ সংস্কৃতি লৌকক মানুষের ভাব ও রসের জীবন্ত উৎস। লোকজ সংস্কৃতির মাঝ দিয়ে লৌকিক মানুষের পিয়াসী হৃদয়ের দুর্বার আকুলি-বিকুলি নানাভাবে প্রচারিত হয়েছে। লোক সংস্কৃতিতে লোক জীবনের ভক্ত পবিত্র অধ্যায়ের ভাবগম্ভীর সংহত প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। বিচিত্র মনের বিচিত্র অনুভূতি অন্যান্য রূপ লাভ করেছে লোকজ সংস্কৃতির মধ্যে।

আমাদের দেশ গ্রামে গাথা। গ্রামই বাংলাদেশের জনজীবনের ও লোক সংস্কৃতির প্রাণ কোষ। গ্রামেই অধিকাংশ লোক বাস করে। তাই লোকসংস্কৃতি ও লোকজীবন নিয়ে পর্যালোচনা করতে হলে গ্রামকে অবশ্যই মূল্য দিতে হবে। আমাদের দেশে বৃত্তির দিক দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণীর লোক আছে। এর মধ্যে কৃষিকাজে জড়িত লোকের সংখ্যা বেশী। কৃষিজীবী মানুষের পাশাপাশি অন্যান্য পেশাজীবীদের মধ্যে আছে- মাঝি-মাল্লা, জেলে, তাঁতী, কামার, কুমার, ছুতার, সেকরা, কাঁসারী, চুনারী, তেলী, মালী, ধোপা, গোয়ালা, ময়রা, কাহার, ঘরামী,টিুয়া, কাঠুরে, বারুই, বেদে, দর্জি, কবিরাজ, ওঁঝা, কসাই, নাপিত, ডোম, চামারসহ আরো অনেক পেশাজীবী মানুষ। এদের জীবনের বিভিন্ন দিক এক নয়। তাই এদের সাংস্কৃতিক জীবনও আলাদা। এর ফলে লোকজ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শ্রেণীতে সমৃদ্ধ হয়ে। আবার দেশের লোক সংস্কৃতি অঞ্চল ভিত্তিক আলাদা রূপ লক্ষ্য করা যায়। এদিক দিয়ে খুলনা জেলা সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। অন্যান্য জেলার মত খুলনা জেলার লোকজ সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। তাই এ জেলার গ্রাম-গঞ্জের মানুষের জীবনকে কেন্দ্র করে পেশাভিত্তিক লোকজ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।

খুলনা জেলার পেশাভিত্তিক লোকজ সংস্কৃতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পালকির গান, ওঝার গান, বাওয়ালীদের গান, গাছ কাটার গান, গাড়োয়ানের গান, জেলেদের গান, কবিরাজের গান, ঘোল তৈরীর গান, চুন তৈরীর গান, কুমারের গান, হাবু গান, ধান কাটার গান, ধুয়া গান ইত্যাদি। এছাড়া আছে তালের পাখা, শোলার খেলনা, বাঁশ ও বেতের পাত্র, মাটির পাত্র, পুতুল ও খেলনা, মাদুর, কাঠের খেলনা ইত্যাদি তৈরি কাজে নিয়োজিত পেশার মানুষের দ্বারা গড়ে ওঠা লোকজ সংস্কৃতি। পালকির গান : সুপ্রাচীন কাল থেকেই গ্রাম বাংলায় পালকির প্রচলন ছিল। পালকির ব্যবহার সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে ছিল। জমিদারদের আট বেহারা/ষোল বেহারায় পালকী এখন অতীত হয়ে আছে। কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হলে পালকীই ছিল অন্যতম প্রধান বাহন। বিয়ে-সাদীতে পালকী না হলে বিয়ের আমেজই পাওয়া যেতো না। পালকীর জন্যে অশনি সংকেত হয়ে এলো যান্ত্রিক যান এবং অন্যান্য বিকল্প বাহন। যান্ত্রিক যানের ব্যবহার যতো বাড়তে লাগলো, পালকীর সুসময় ততো নাগালের বাইরে যেতে লাগলো। কোথাও কোথাও পালকীর ব্যবহার থাকলেও তা সীমিত। পাইকগাছা (খুলনা) থেকে পালকী বওয়ার কিছু গান ‘নোরাড' প্রকল্পাধীন ভিডিও'তে ধারণ করা হয় ।

 

রবিন্দ্রনাথের কুঠি বাড়ি।।।।

 

সরকারি বি. এল কলেজ

 

সুন্দর বন

 

ষাট গম্বুজ মসজিদ

সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতিবিজড়িত খুলনার জেলা প্রশাসকের বাসবভনে অবস্থিত বকুলতলায় নববর্ষ উদযাপন, ফুলতলার দক্ষিণডিহি রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়িতে রবীন্দ্রমেলা, পাইকগাছার রাড়ুলি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জন্মভিটায় জন্মবার্ষিকী ও দুবলার চরে সাগরস্নান উপলক্ষে রাসমেলা।

বাগেরহাট- খানজাহান মেলা।

সাতক্ষীরা- গুড়পুকুরের মেলা ও নলতাশরীফের ওরস।

যশোর- কেশবপুরের সাগরদাড়িতে মধুমেলা।

নড়াইল- সুলতান মেলা।

কুষ্টিয়া- ছেউড়িয়ার লালন উৎসব ও শিলাইদহের রবীন্দ্রমেলা।