দেশের সীমানা নদীর ঠিকানা
যেথা গিয়েছে হারিয়ে
সেথা সাতক্ষীরা রূপমায়া ঘেরা
বনানীর কোলে দাঁড়িয়ে।
সাতক্ষীরা শহর পেরিয়ে যতই যেতে থাকবেন বঙ্গপোসাগরের কোল ঘেঁষা সুন্দরবনের সীমায়, অজ্ঞাত কবির লেখা এই চরণগুলি আপনাকে ততই দাঁড় করাবে সুন্দর সত্যের মুখোমুখি। মানচিত্রের সবুজ যে দেশের প্রাণ, সে দেশের সবুজ কতো সুন্দর, মহোময়, উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত তা কি একবার ভেবে দেখেছেন? দেখেছেন সবুজ গ্রাম আর বন-বনানীর দিকে একবার তাকিয়ে? উপভোগ করেছেন এর মনোলোভা সৌন্দর্য? হয়তো কবির মতো বলবেন ‘সময় কোথা সময় নষ্ট করবার’।
নাগরিক জীবনের বিষাক্ত বাতাস, ক্লেদাক্ত কর্মময় জীবন থেকে ছুটি নিয়ে দেখে আসুন না গাঢ় সবুজের মেলা। যে মেলায় শুধু সবুজ খেলা করে। আর সবুজের সঙ্গে খেলা করে হরেক জীবজন্তু, পাখপাখালি, কীটপতঙ্গ আর বঙ্গোপসাগর থেকে ছুটে আসা জলভেজা বাতাস। হ্যাঁ, সুন্দরবনের কথা বলছি। যে বন আমাদের প্রাণে আনন্দের খোরাক যোগায়, শত ব্যস্ততা দূরে সরিয়ে সময়কে উপভোগ করার প্রণোদনা দেয়। সেই সময়কে কি সময় নষ্ট বলা যায়? নিশ্চয় না।
বাংলাদেশের ৬টি জেলা জুড়ে সুন্দরবন বিস্তৃত হলেও একমাত্র সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর থানার মুন্সিগঞ্জ থেকে সরাসরি দেখা যায় সুন্দরবনের সবুজ আবহ। ঢাকা থেকে রওনা হলে সরাসরি মুন্সিগঞ্জ গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে যতদূর আপনার চোখ যাবে, শুধু দেখবেন সবুজ সীমানা।
মংলা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট যেদিক দিয়েই সুন্দরবন যান না কেন, বন দেখার জন্য নদীপথে ছুটতে হবে অনেকটা দূর। একমাত্র সাতক্ষীরার কোলঘেঁষা সুন্দরবন ব্যতিক্রম। বন যেন ময়ুরের মতো সুন্দর পেখম মেলে বসে আছে তার অগণিত প্রণয়ীর প্রতীক্ষায়। সাতক্ষীরা শহর পেরুলেই রাস্তার দুপাশের বড় বড় সবুজ বৃক্ষ আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবে সুন্দরবনের পথে। আপনার গাড়ি চলতে থাকবে সবুজ টানেলের ভেতর দিয়ে।
সাতক্ষীরা দিয়ে সুন্দরবন দেখার জন্য আপনি ঢাকা থেকে রওনা হতে পারেন রাত ৯টা, ১০টা অথবা ১১টার গাড়িতে। তাহলে হাতে পাবেন একদিন বেশি সময়। গাড়ি আপনাকে সকাল ৭টার মধ্যেই পৌঁছে দেবে শ্যামনগর বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে মাইক্রো অথবা পাবলিক বাসে ১৫ কিলেমিটার গেলেই দেখতে পাবেন সবুজ বন; শরীরে এসে ছুঁয়ে যাবে শীতল হাওয়া।
পর্যটন খাতে আমাদের আয়ের পর্যাপ্ত সুযোগ থাকলেও অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে এ খাত আজও অনেক পিছিয়ে। সাতক্ষীরা সুন্দরবনও তার ব্যতিক্রম নয়।
সাতক্ষীরার মালঞ্চ, কালিন্দী, রায়মঙ্গল, খোলপেটুয়া, বুড়িগোয়ালিনী নদীর তীর ছুঁয়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনে ঘোরার জন্য পর্যাপ্ত বোট থাকলেও বন দেখে এসে থাকা খাওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এখানে ছিলোনা কখনোই। সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো পর্যায় থেকেই শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জে স্থাপন করা হয়নি ভালো মানের কোনো হোটেল বা রেস্ট হাউস। তবে, সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘সুশীলন’ মালঞ্চ নদীর তীর ঘেঁষে নির্মাণ করেছে ‘টাইগার পয়েন্ট’ নামে একটি যথেষ্ট মানসম্পন্ন রেস্ট হাউস। এছাড়া আরও একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘বর্ষা’ও নির্মাণ করেছে একটি বিনোদন কেন্দ্র। সুতরাং, থাকা কিংবা গাড়ি থেকে নেমে একটু ফ্রেশ হয়ে বন দেখতে বেরিয়ে পরার কোনো সমস্যা এখন আর নেই। মুন্সিগঞ্জ বন বিভাগের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে চলে যেতে হবে ইঞ্জিনচালিত নৌকার ঘাটে। প্রতি ঘণ্টায় এই নৌকায় ভাড়া গুনতে হবে ৩০০-৪০০ টাকা। বড় নৌকার ভাড়া একটু বেশি।
নৌকা চলতে শুরু করবে মাঝারি আকৃতির মালঞ্চ নদী দিয়ে। দুপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ। তবে হরিণ, বানর, বনমোরগ প্রভৃতি প্রাণী দেখতে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। অপনাকে যেতে হবে বেশ কিছুক্ষণ। নৌকা যখন ঢুকবে ছোট শাখা নদী বা খালগুলোতে তখন কিন্তু অপনার গায়ে কাটা দিতে শুরু করবে। এই বুঝি বাঘ এসে পড়ল আপনার গায়ের উপর। আর গাঢ় সবুজ অন্ধকারের মাঝে শীতল হাওয়া ভয়টা একটু বেশিই বাড়িয়ে তুলবে।
বোটম্যানকে বললে নিরাপদ স্থানে আপনাকে নামিয়ে দিবে বনের মধ্যে। কিন্তু, বেশি সাহস দেখিয়ে ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না, তাতে বিপদ হতে পারে। কাদায় নামার আগে খেয়াল রাখবেন পায়ের দিকে। কারণ গাছের অদ্ভুত খাড়া খাড়া শ্বাসমূল পায়ে ফুটে যেতে পারে। সুন্দরবনের সুন্দরী, গরান, গেওয়া, কেওড়া, গোলপাতা, খলিসাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ চিনতে আপনাকে সহায্য করবে বোটম্যান অথবা গাইড। গাইড নেয়াসহ সব ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করবে সেই টাইগার পয়েন্ট রেস্ট হাউসের কর্মীরা।
নৌকায় চড়ার আগে কিন্তু বেশি করে শুকনা খাবার এবং পানি নিতে ভুলবেন না। কারণ নদীর লোনা হাওয়া আপনার ক্ষুধাকে বাড়িয়ে তুলবে কয়েক গুণ। বুড়িগোয়ালিনী গিয়ে নৌকা থেকে নেমেও খাবার কিনে নিতে পারবেন। সাথে বনবিভাগের পোষা হরিণ, বানর দেখতে পাবেন। বনে ঘোরা যাবে প্রায় ৬-৮ ঘণ্টা। সারাদিন ঘুরে এসে পরদিন আশপাশের গ্রামে বসবাসরত মৌয়াল, বাওয়াল ও মুন্ডা নামক আদিবাসীদের জীবনযাত্রাটা একবার দেখে নিতে পারেন।
এই এলাকার খাওয়া-দাওয়াটা কিন্তু সেরে নিতে পারেন স্পেশালভাবে। বিশেষ করে এখানে এমন কিছু মাছ পাওয়া যায় যা দেশের অন্য কোথাও দেখা পাওয়া যায়না বললেই চলে। মাছগুলোও কিন্তু অনেক সুস্বাদু। তবে পছন্দের খাবারের জন্য একমাত্র ভরসা টাইগার পয়েন্টের ক্যান্টিন। এই ক্যান্টিনে দুপুর এবং রাতের খাবার পাবেন ১০০-১২০টাকায়। এর সাথে কিছু অতিরিক্ত টাকা যোগ করে চিংড়ি, ভেটকি, ভাঙান, পাসসে, কাইন, বাঁশপাতা, খয়রা, তপস্বে, দাঁতনেসহ বিভিন্ন প্রজাতির নদীর মাছ খাওয়ার সুযোগ তো থাকছেই। তবে ভুল করে হরিণের মাংস খাওয়ার কথা না বলাই ভালো। কারণ এটা একবারেই নিষিদ্ধ।
থাকা-খাওয়া
থাকার জন্য সুশীলনের টাইগার পয়েন্ট এবং বর্ষার রেস্ট হাউসই ভরসা। টাইগার পয়েন্টে রুমপ্রতি ভাড়া ৫০০-১৭০০ টাকা। তবে ডরমেটরি টাইপের কিছু রুমে প্রতি বেডের ভাড়া পড়বে ২০০টাকা। এখানে ৩টি আধুনিক সুবিধাসহ কনফারেন্স রুমও আছে। এছাড়া, একসঙ্গে ১০০ জন মানুষ এখানে থাকতে ও খেতে পারবে। এখানে আরও একটি স্পেশাল সুযোগ পাবেন। সেটা হলো, ছাদে বসে বাডর্স আই ভিউ থেকে সুন্দরবন দেখা। আর চাঁদনি রাত যদি পেয়ে যান, তাহলে তো কথাই নেই।
যাতায়াত
ঢাকার কল্যাণপুর, মালিবাগ ও গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে সোহাগ, সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস, কে লাইন, একে ট্রাভেলস, এম আর, ঈগল, এসপি গোল্ডেন লাইনপরিবহনসহ প্রায় ১২টি পরিবহনে সাতক্ষীরা যাওয়া যায়। একে ট্রাভেলস এবং এম আর পরিবহনে সরাসরি যাওয়া যায় সাতক্ষীরা শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জে। ভাড়া ৫০০ টাকা। তবে এসি পরিবহনে যেতে পারবেন সাতক্ষীরা সদর পর্যন্ত। ভাড়া ৭০০-১০০০ টাকা। সকাল, দুপুর ও রাতের তিনটি নির্দিষ্ট সময়ে গাড়িগুলো ঢাকা ছেড়ে যায়।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস